২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের জন্য জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন বিভিন্ন স্তরের মোট ৪৯ জনকে দায়ী করেছে। এই অভিযুক্তদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, র্যাব ও বিডিআর কর্মকর্তা, সাবেক ও বর্তমান আইজিপি এবং তিনজন সংবাদকর্মী অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। কমিশনের একজন সদস্য নিশ্চিত করেছেন যে এসব তথ্য চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, অভিযুক্তরা কেউ ঘটনার পরিকল্পনায়, কেউ সহায়তায়, কেউ উসকানিতে এবং কেউ দায়িত্বে অবহেলার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন ১১ মাসের অনুসন্ধান শেষে গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয়। ২০০৯ সালের ওই মর্মান্তিক ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
গতকাল সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, সরকার বিশাল ভলিউমের প্রতিবেদনটি গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করছে এবং সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
কমিশনের সূত্র থেকে জানা যায়, ঘটনার কয়েক মাস আগে তৎকালীন সাংসদ ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস পিলখানায় বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে সৈনিকদের অসন্তোষের তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর তাঁর বাসভবনে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সোহেল তাজ ও আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ২৪ জন সদস্যের সঙ্গে বৈঠক হয়। অভিযোগ রয়েছে, সেখানেই বিদ্রোহ ও কর্মকর্তা হত্যার পরিকল্পনা করা হয় এবং ব্যারিস্টার তাপসকে পলায়নে সহায়তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে ভারতীয় গোয়েন্দাদের অংশগ্রহণ এবং পরিকল্পনায় প্রত্যক্ষ ভূমিকার একাধিক প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। একাধিক সাক্ষী জানিয়েছেন যে বিদ্রোহের দিন পিলখানায় হিন্দি ও ভিন্ন উচ্চারণে বাংলায় কথোপকথন শুনেছিলেন। এছাড়া, ঘটনাকালে ৮২৭ জন ভারতীয় পাসপোর্টধারীর দেশে প্রবেশ এবং তাঁদের মধ্যে ৬৫ জনের বহির্গমনের কোনো তথ্য না থাকাকে তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ঘটনায় মোট ১৭ জন রাজনৈতিক ব্যক্তির সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়ার পরই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়। বিদ্রোহের শুরুতে পরিস্থিতি জানার পরও সেনা পাঠাতে বিলম্ব হওয়ায় হত্যাকারীরা পালানোর সুযোগ পায় বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদসহ সামরিক বাহিনীর ১২ জন সাবেক কর্মকর্তা, র্যাবের চারজন, বিডিআরের তিনজন এবং পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও সন্দেহজনক আচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অনেকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও কার্যকর ব্যবস্থা নেননি।
কমিশন জানিয়েছে, ঘটনার সময় কিছু টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যম যাচাইবাছাই ছাড়াই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্তেজনাকর তথ্য প্রচার করে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে এবং বিদ্রোহীদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়।
কমিশনের পক্ষ থেকে পুনঃতদন্ত, ট্রাইব্যুনালে বিচার এবং প্রতিবেদনটি সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশ করার সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন সদস্য মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন জানিয়েছেন, আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।